সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মার্কসবাদ সভ্যতার অগ্রগতিতে ও মানবিকীকরণে বিশ্বাসী। আর ওই কারণেই সে শিল্প-সাহিত্যের নিরন্তর অনুশীলন চায়, এবং পথ-উন্মোচন করতে সচেষ্ট থাকে সৃষ্টিশীলতার। একই সঙ্গে চায় অর্জনগুলোকে সর্বজনলভ্য করে তুলতে। শ্রেণির বিভাজন ভেঙে শিল্প-সাহিত্য যাতে সকলের কাছে পৌঁছে যায়, এটি মার্কসবাদীদের সংস্কৃতিচর্চার একটি লক্ষ্য বটে। আরও একটা কাজে সাহায্য করে মার্কসবাদ। সেটি হলো শিল্প-সাহিত্যের ভেতরে কী ঘটছে, কেন ঘটছে, তার ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা।
মার্কসবাদের নানা কৃতিত্বের মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে সকল মানবিক কাজের পেছনেই যে ইতিহাস আছে অমোঘ সেই সত্যটিকে বিবেচনায় নিয়ে আসা। মার্কসবাদ ভাববাদী ঈশ্বরের ব্যাপারে উদাসীন; কিন্তু বলা হয়ে থাকে যে মার্কসবাদীরা ঈশ্বরের জায়গাতে ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেটা এই অর্থে যে সবকিছুরই ইতিহাস আছে, ইতিহাসের বাইরে কিছুই নয়, ইতিহাসের ভেতরে থেকে এবং ইতিহাসের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে নিয়োজিত অবস্থাতেই মানুষের সৃষ্টিশীলতা কাজ করে। ইতিহাসেরও ইতিহাস আছে। ইতিহাসে থাকে শ্রেণি, থাকে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব জিনিসটা সর্বত্রই কার্যকর। কার্য ও কারণের মধ্যে যে সম্পর্কটা কাজ করে তার চেয়েও দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক অনেক বেশি সত্য বটে। দ্বন্দ্ব বাধে অধিপতি শ্রেণির মতাদর্শের সঙ্গে অধিপতিত শ্রেণির মতাদর্শের। বিদ্যমান সমাজে অধিপতিদের মতাদর্শই রাজত্ব করে থাকে। আর এইসব দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই ইতিহাস এগোয়।
শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টির পেছনে অনুপ্রেরণা নিশ্চয়ই কাজ করে। এমনও মত আছে যে সৃষ্টির কাজটা উন্মাদনার ভেতরেই ঘটে। আরেকটা মত এই যে শিল্পীরা অনুকরণ করেন। অনুকরণ করেন যা কিছু দেখেন ও কল্পনা করেন তার। কিন্তু এই অনুকরণ কখনোই যান্ত্রিক থাকে না, সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠে; শিল্পীর অনুকরণ মানেই নতুন সৃষ্টি। আসলে কিন্তু অনুপ্রেরণা ও অনুকরণ- এই দুই ধারণাই সত্য। দার্শনিক প্লেটো অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন, তাঁর দুর্ধর্ষ ছাত্র অ্যারিস্টটল বলেছেন অনুকরণের কথা। একজন ভাববাদী, অন্যজন বাস্তববাদী। ওই ধারণা দুটি কিন্তু পরস্পরবিরোধী নয়; বরঞ্চ একে অপরের পরিপূরকই। অনুপ্রেরণা ভিন্ন শিল্পের সৃষ্টি যে সম্ভব নয়; এটা সত্য; আবার অনুপ্রাণিত শিল্পী যেহেতু সমাজে বসবাস করেন, এবং সমাজের বাস্তবতার ভেতরে থেকেই যেহেতু তাঁর শিল্প-সৃষ্টি, তাই সমাজ তার কল্পনাকে ছাড় দেয় না, প্রভাবিত করে। নিয়ন্ত্রিতও করতে চায়। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে শিল্পীরা সেই নিয়ন্ত্রণের ভেতরে থাকেন, কিন্তু আবার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হন। হতেই হয়। নইলে তো তাঁরা সাধারণদের একজন হয়ে যাবেন। শিল্পী হবেন না। ইতিহাসের উপস্থিতিটা থাকেই।
উদাহরণ নেওয়া যাক। শেক্সপিয়র এবং টলস্টয় উভয়েই অতুলনীয় শিল্পী। একজন লিখেছেন নাটক, অন্যজন উপন্যাস। এই যে তাঁরা দুটি ভিন্ন রূপকল্প অবলম্বন করলেন; এর পেছনে ইতিহাস কাজ করেছে। নীরবে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে। শেক্সপিয়রের পক্ষে উপন্যাস লেখা মোটেই সম্ভব ছিল না। নিষেধ ছিল ঐতিহাসিক বাস্তবতার। বাস্তবতা হলো- নাটক এসেছে আগে, উপন্যাস পরে। প্রাচীনকালে নাটক লেখা হতো কবিতায়, কারণ কবিতার আগমনই সর্বপ্রথম। গদ্য এসেছে পরবর্তী সময়ে। সেকালে মহাকাব্য ছিল। মহাকাব্য কবিতায় লেখা হতো। মহাকাব্য বীরদের কাহিনি। কিন্তু একসময়ে টের পাওয়া গেল যে বীরদের আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ পাঠক সাহিত্য চাইছে, সে পাঠক আবার মধ্যবিত্ত। কারণ, এরই মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। মধ্যবিত্ত ঘরে বসে সাহিত্য পড়তে চায়, থিয়েটারে গিয়ে নাটক দেখবে- এমন সুযোগ তার জন্য সীমিত। সাহিত্যের চাহিদাটা তখন বিশেষভাবে এসেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মহিলাদের কাছ থেকে, যারা লেখাপড়া শিখেছে, কিন্তু থাকে ঘরের ভেতরেই। সাহিত্যিক সেই চাহিদা মেটাবার জন্য আশপাশের মানুষদের নায়ক-নায়িকা করে উপন্যাস লেখা শুরু হলো।
অসামান্য মানের নাটক লিখেছেন শেক্সপিয়র। সেসব নাটক মূলত রাজা-রানী, রাজদরবার ও অভিজাতদের নিয়েই। শেক্সপিয়রের কালে সমাজে এরাই ছিল ক্ষমতাধর। তবে তিনি রাজতন্ত্রের সমালোচনাও করেছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ দুটি নাটকের একটি ‘হ্যামলেট’, অন্যটি ‘কিং লিয়র’। দুটি নাটকেই দেখানো হচ্ছে রাজবাড়ির রাজনীতিটা কেমন নিষ্ঠুর। রাজপুত্র হ্যামলেট এবং রাজা লিয়র দু’জন ভিন্ন ভিন্ন দুই দেশের মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন সময়েরও; কিন্তু তাঁরা উভয়েই নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন। উভয়ের পরিণতিই নির্মম। শেক্সপিয়র রাজতন্ত্রের ভেতরটাকে একেবারে উন্মোচিত করে দেখাচ্ছেন। কিন্তু তাই বলে রাজতন্ত্রের যে উচ্ছেদ চেয়েছেন তা কিন্তু নয়। ‘হ্যামলেট’ নাটকে রাজপরিবারের সবাই শেষ পর্যন্ত মারা গেল; কিন্তু শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে পাশের দেশের এক রাজপুত্র মঞ্চে প্রবেশ করছে, মঞ্চের ওপর পড়ে-থাকা লাশগুলো সরিয়ে নিয়ে দর্শকদের জন্য সে নাটকের যবনিকা টানবে। সেকালের মঞ্চে পর্দা টানার ব্যবস্থা ছিল না, লাশ সরানোর কাজটা ওই রাজপুত্রের সৈন্যসামন্ত দিয়েই সম্পন্ন করা হলো, আবার একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়াও হলো যে রাজা মারা গেছে সত্য, রাজত্বের একমাত্র উত্তরাধিকারী রাজপুত্র হ্যামলেটও শেষ, কিন্তু তাই বলে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে অবসান ঘটল তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ‘কিং লিয়র’ নাটকেও ওই একই আশ্বাস। রাজা লিয়র মারা গেছেন, কন্যারাও কেউ জীবিত রইল না, তবে মৃত কন্যাদের একজনের স্বামী ঘটনাস্থলে উপস্থিত, তুলনায় ভদ্র গোছের মানুষ সে; বোঝা যাচ্ছে রাজত্ব চালানোর দায়িত্ব সে-ই তুলে নেবে নিজের কাঁধে। শেক্সপিয়র নিজে রক্ষণশীল ছিলেন। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ তিনি, রক্ষণশীলতা তাঁর শ্রেণিরই একটি বৈশিষ্ট্য। এই মধ্যবিত্ত জনতাকে পছন্দ করত না, শেক্সপিয়রও করেন না, কিন্তু তবু বড় শিল্পী যেহেতু তাই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নৃশংসতা না-দেখিয়ে পারেননি। সেখানেই তাঁর মহত্ত্ব। রাজতন্ত্র যে টিকবে না সেটা তাঁর ওই উন্মোচন জানিয়ে দিচ্ছে।
টলস্টয়কেও রক্ষণশীল বলতে হবে। শেক্সপিয়রের তিনশ বছর পরের মানুষ তিনি। তাঁর সময়ে তাঁর দেশে অত্যাচারী সম্রাটদের রাজত্ব চলছিল, কিন্তু টলস্টয়ের সাহিত্য জগতে তাদের সরাসরি উপস্থিতি নেই। তবে সম্রাটের সহযোগী আমলাতন্ত্র খুবই তৎপর রয়েছে। টলস্টয় উপন্যাস লিখছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, তাঁর দেশে তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রস্তুতি চলছে। টলস্টয় শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘আন্না কারেনিনা’তে তাঁর সময়কার বুর্জোয়া আমলাতন্ত্র ও অভিজাত সমাজের সংকট দেখাচ্ছেন। পরিবার ভেঙে পড়ছে। ওদিকে আবার পরিবর্তনের জন্য পথানুসন্ধান চলছে। আন্দোলনও গড়ে উঠছে। ‘আন্না কারেনিনা’ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস; বিশ্ব কথাসাহিত্যেও এই রচনা অনন্যসাধারণ। উপন্যাসের নায়িকা আন্না রূপে গুণে অসামান্য। বুর্জোয়া সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিই বলা যাবে তাকে, নানা দিক থেকে। কিন্তু নিজের জীবনে ওই নারী চরিতার্থতা পেল না; শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলো আত্মহত্যা করতে। বয়সে তার স্বামী আন্নার চেয়ে বিশ বছরের বড়, সামাজিক অবস্থানে আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ স্তরে তার প্রতিষ্ঠা; স্বামীর বিপরীতে রয়েছে আন্নার সমবয়স্ক ভ্রনস্কি, যে তার প্রেমিক। সেও আমলাতন্ত্রের লোক, তবে বেসামরিক নয় সামরিক আমলাতন্ত্রের। দু’জনের কেউই আন্নাকে চরিতার্থতা দিতে পারে না- না তার স্বামী, না তার প্রেমিক। চলন্ত ট্রেনের নিচে নিজেকে নিক্ষেপ করে আন্না তার অতৃপ্ত জীবনের অবসান ঘটায়। চলন্ত ওই ট্রেন আগ্রাসী পুঁজিবাদের প্রতিনিধি যেন। তার চাকার নিচে পিষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা। পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের জন্য ব্যস্ত মানুষও কিন্তু আছে। আছে লেভিন। প্রতিনায়ক সে। কৃষিতে শ্রমের ভূমিকাকেই সে মুখ্য হিসেবে দেখে। নিজের পরিবারের ভূমিদাসদের সে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। তাই বলে সে যে সমাজবিপ্লবী তা নয়। তবে তার আশপাশেই সমাজবিপ্লবীরা আছে। লেভিনের আপন ভাই যোগ দিয়েছে বিপ্লবীদের গোপন দলে। সে-দল কমিউনিস্টদের। বিপ্লবীদের সন্ধান পাব টলস্টয়ের অপর উপন্যাস ‘পুনরুত্থান’-এও। সেখানে দেখি বিপ্লবীদের নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে সাইবেরিয়াতে। বন্দিরা বই পড়ে, তারা চিন্তা করে, তাদের একজনের কাঁধের থলের ভেতর থেকে মার্কসের বই উঁকি দেয়। না, টলস্টয় নিজে সশস্ত্র বিপ্লবে আস্থাশীল নন, কিন্তু বিপ্লব যে আসছে তার সংবাদ তিনি দিচ্ছেন। সমাজে দ্বন্দ্ব বিকশিত হচ্ছিল। টলস্টয় তার সংবাদ পাচ্ছেন এবং পাঠকদের সে-সংবাদ জানাচ্ছেন। এবং বিপ্লব যাতে ঘটে তার জন্য সাহায্যও করছেন, বাস্তবতা সবার জন্য উন্মোচিত করে দিয়ে।
রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপে চিত্রকলার অত্যাশ্চর্য বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেল এঞ্জেলো এমন সব ছবি এঁকে রেখে গেছেন যেগুলো তুলনাহীন। মার্কসবাদ বলবে এর পেছনে ছিল ইতিহাস। রেনেসাঁ একটা নবজাগরণ এনেছিল; চিন্তায়, উৎপাদনে ও বাণিজ্যে এবং স্বভাবতই দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই নবজাগরণেরই প্রকাশ ঘটেছে চিত্রকলাতে। রেনেসাঁর বিশেষ সমৃদ্ধি ইতালিতে। নবজাগরণের প্রথম কেন্দ্র ছিল ওইখানেই। স্থল ও জলপথে ইতালি যুক্ত ছিল অন্য দেশের সঙ্গে; সেখানে বাণিজ্যের চর্চা চলছিল মহোৎসাহে। বাণিজ্য জিনিসটা নিতান্তই ইহজাগতিক; রেনেসাঁও যেমন মতাদর্শিক তেমনি ইহজাগতিক, তাই দেখি তার শিল্পীরা ধর্মীয় বিষয় নিয়েও যখন ছবি আঁকেন তখন তাতে মনুষ্যজীবনের মহিমা, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও অনুভূতির বলিষ্ঠতা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নতুন এক বিশ্ববিভা, শিল্পী ও শিল্প উভয়ের চোখেমুখে।
রেনেসাঁ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মুক্তির; কিন্তু প্রতিশ্রুত সে-মুক্তিটা এলো না; কারণ রেনেসাঁ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করল তা পুঁজিবাদী চরিত্রের। পুঁজিবাদ সব মানুষকে সমান করে না, উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে। রেনেসাঁর কালে বিকশিত ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যবোধ গণতন্ত্র দাবি করছিল, কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা মোটেই গণতান্ত্রিক নয়। ব্যাহত-গতি সভ্যতাকে তাই আরও একধাপ এগুবার জন্য সচেষ্ট হতে হলো। প্রয়োজন দেখা দিল সামাজিক বিপ্লবের। ওই অগ্রগতির কারণেই ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে বিপ্লব ঘটে। বিপ্লবের সেই ঘটনার পেছনে ফরাসি লেখকদের দার্শনিক ও সাহিত্যিক রচনার অবদান ছিল। বিপ্লব যখন ঘটল, ঘটেই গেল, তখন ইংল্যান্ডের তরুণ লেখকদের কেউ কেউ অত্যন্ত উদ্দীপিত হয়েছিলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ তো মনে করেছিলেন পৃথিবীতে এসেছে নতুন দিন। বিপ্লবে যোগ দেবেন বলে তিনি ফ্রান্সে রয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি ফেরত এসেছেন, তাঁর নিজের শ্রেণির কাছেই। সেকালের মধ্যবিত্ত শ্রেণি আসলে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সমাজ বিপ্লবের প্রচণ্ডতা দেখে। ভয় পেয়েছিলেন উদারপন্থি এডমন্ড বার্কও। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে বার্ক পার্লামেন্টে উদার কণ্ঠে বক্তৃতা করেছেন, ভারতে কোম্পানি শাসনে দুর্নীতির ঘটনার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন; কিন্তু তাঁকেই আবার দেখা যায় ফরাসি বিপ্লবের বিপক্ষে বই লিখতে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উদারনীতিক বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, ইংল্যান্ডবাসীকে তাঁরা সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন বিপ্লবের ব্যাধিটি কোনোমতেই যেন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে ঘাঁটি না গাড়ে।
ওদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর নিজের দেশে পুঁজিবাদের উদ্বেগজনক উত্থান-তৎপরতা দেখতে পাচ্ছিলেন। দেখছিলেন গ্রামের কৃষক কীভাবে উৎপাটিত হয়ে শহরে চলে আসছে, এসে পরিণত হচ্ছে মজুরি শ্রমিকে, আবাস খুঁজছে নোংরা বস্তিতে। এই দৃশ্যে তিনি পীড়িত হয়েছেন। সমাধানটা কী? না, পুঁজিবাদের উচ্ছেদের কথা ভাবেননি; পলায়নই বরঞ্চ করতে চেয়েছেন, প্রকৃতির কাছে। কিন্তু সে তো কবির পলায়ন, মানসিকভাবে; মেহনতি মানুষ যাবে কোথায়? কে দেবে তাকে জীবিকার নিশ্চয়তা? উত্তর নেই। ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রগতিশলীতা অনস্বীকার্য। কবিতাকে তিনি নিয়ে যেতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে; ঠিক করেছেন সাধারণ মানুষকে নিয়েই লিখবেন। লিখবেন কথোপকথনের ভাষাতে। ঘোষণাটা দিয়েছিলেন নিজের কাব্যযাত্রার একেবারে সূচনালগ্নে। এগিয়ে তিনি গেছেনও। তাতে কবিতার লাভ হয়েছে, মেহনতিদের বড় একটা লাভ হয়নি। পুঁজিবাদের জোয়াল তাদের কাঁধে ক্রমান্ব্বয়ে শক্তই হয়েছে।
ঔপন্যাসিক জেন অস্টেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের সমসাময়িক। ওয়ার্ডসওয়ার্থের তুলনায় তিনি অনেক বেশি রক্ষণশীল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির রক্ষণশীল অংশেরই প্রতিনিধি তিনি। একে তো মহিলা, তার ওপর থাকতেন মফস্বলে, সাহিত্যিকদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না; নিজে নিজে একাকী চুপি চুপি লিখতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কার্ল মার্কসের আবির্ভাবের আগেই তিনি মার্কসবাদী হয়ে গেছেন। প্রেম ও বিবাহের বিষয় নিয়েই সাধারণত লিখতেন, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে পরিস্কার বুঝে নিয়েছিলেন যে মানবিক সম্পর্কগুলো কোনো মতেই অর্থনীতির বাইরে নয়; আবেগ যতই দুর্দমনীয় হোক, সম্পত্তি ও অর্থ না থাকলে সম্পর্ক জমে না। কিন্তু তিনি আবার মার্কসবাদীদের থেকে দূরেই থেকে যান যখন সম্পত্তিব্যবস্থাকে মেনে নেন। বাস্তববাদী অবশ্যই, কিন্তু মোটেই বিপ্লবী নন; ফরাসি বিপ্লবের পরে লিখেছেন কিন্তু বিপ্লব তাঁকে নাড়া দেয়নি। থেকেছেন তিনি গৃহের বন্ধনে, পারিবারিকভাবে যেমন তেমনি মানসিকভাবেও।
তাঁর পরের কালের লেখকরা কেউ কেউ পুঁজিবাদের নৃশংসতার ছবি এঁকেছেন তাঁদের লেখাতে। যেমন চার্লস ডিকেন্স। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের হৃদয়বিদারক চিত্র আছে তাঁর উপন্যাসে। সেদিক দিয়ে জেন অস্টেন থেকে তিনি যোজন যোজন দূরের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও ওই মধ্যবিত্তই, সামাজিক পরিবর্তনে অবিশ্বাসী।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যে পুঁজিবাদের বিস্তর সমালোচনা আমরা পাব। ডিকেন্স তো আছেনই, পুঁজিবাদের সমালোচনা ম্যাথু আর্নল্ডও করেছেন; যেমন করেছেন টমাস কার্লাইল। আর্নল্ড ভাবতেন পালাবেন তিনি প্রাচীন ধ্রুপদি সংস্কৃতির কাছে : কার্লাইল ভাবতেন আশ্রয় নেবেন বীরদের পক্ষপুটে। মুক্তির সোজা পথটা যে সমাজ বিপ্লব সেটা তাঁরা ভাবতে পারেননি। নিষেধ ছিল শ্রেণির। ধরে নিয়েছেন সংস্কারেই কুলাবে। মার্কস কিন্তু ওই সময়েই, এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ হয়েও, সন্ধান পেয়ে গেছেন এই সত্যের যে ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা ছাড়া উপায় নাই। এই যে তিনি ভাবতে পারলেন যথার্থ সামাজিক বিপ্লবের কথা, এটা সম্ভব হলো কীভাবে? প্রথমত মেধা ছিল; দ্বিতীয়ত ছিল শ্রেণিচ্যুতির ক্ষমতা। অন্যরা পারেননি, তিনি পেয়েছেন। সমস্যাটিকে তিনি তাঁর নিজের শ্রেণিস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি, দেখেছেন মেহনতিদের দৃষ্টিকোণ থেকে। মার্কসবাদ ওইখানেই বিশেষভাবে স্বতন্ত্র। মার্কসবাদ জানিয়ে দেয় যে কেবল দেখা নয়, কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সেটাই বরঞ্চ অধিক জরুরি। আর দেখাটাই যে যথেষ্ট তাও নয়, প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়ানো।
বিংশ শতাব্দীর মস্ত বড় ঘটনা বিশ্বযুদ্ধ এবং রাশিয়াতে ও চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লব মার্কসবাদীরাই ঘটিয়েছেন। তা বিপ্লবের জন্য শিল্প-সাহিত্যে প্রস্তুতিটা কেমন ছিল? ছিল যথোপযুক্ত। রুশ সাহিত্যে তো বটেই, চীনের সাহিত্যেও, বিশেষ করে নবীনদের রচনায়, বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিন এবং চীন বিপ্লবের প্রধান মাও সে তুং- দু’জনেই যেমন সংগঠক ছিলেন, তেমনি ছিলেন লেখকও। কিন্তু অন্যত্র? অন্যসব দেশে? হ্যাঁ, অন্যত্র বিপ্লবী চেতনা নিশ্চয়ই ছড়িয়েছে, এমনকি বিপ্লবও ঘটেছে, কিন্তু রুশ ও চীন বিপ্লবের মতো কোথাও নয়। সত্য এই যে রুশ বিপ্লব দেখে বিপ্লব-বিরোধীরা একাট্টা হয়ে গিয়েছিল। তারা বিরোধিতা করেছে।
এরই মধ্যে অবশ্য নাটক লিখেছেন বার্টল্ট ব্রেখট এবং আর্থার মিলার। তাঁরা সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন; ব্রেখট স্পষ্ট করে, মিলার অবশ্য অতটা স্পষ্ট নন। আমেরিকায় বসে তাঁরা লিখতেন। কিন্তু পুঁজিবাদী আমেরিকা তাঁদের স্বাধীনতা দেয়নি লেখার; পীড়ন করেছে বরঞ্চ। ইউরোপে তরুণ লেখকরা কেউ কেউ বিপ্লবের পক্ষে লিখেছেন, এমনকি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্পেনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, প্রাণও দিয়েছেন কয়েকজন। অন্যদিকে আবার কেউ কেউ স্ট্যালিনের তথাকথিত একনায়কত্বকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে সমাজতান্ত্রিক শিবির ত্যাগ করে হয় উদারনীতির পক্ষে, নয়তো সরাসরি রক্ষণশীল শিবিরেই চলে গেছেন।
রুশ বিপ্লব দেখে অনেক বুদ্ধিজীবীই আবার ঘাবড়ে গেছেন। তাঁদের কেউ চলে গেল ধর্মের আশ্রয়ে, কেউ কেউ অতীত ইতিহাসের কাছে। ভেবেছেন উটপাখির মতো মুখ গুঁজে ঝড় থেকে বাঁচা যাবে। আদিমতার কাছে প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও দেখা গেছে। ইংরেজি সাহিত্যে এলিয়ট আনলেন ধর্মের বাণী, লরেন্স দুঃখ পেলেন পুঁজিবাদ মানুষের ইন্দ্রিয় সংবেদনশীলতাকে খাটো করছে দেখে, ইয়েটস ভাবলেন ঠিক আছে জাতীয়তাবাদীই হবেন। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করতেন তাঁর ভেতরে আধ্যাত্মিকতার যে সুর শুনতে পেয়েছেন সেই সুরের জন্য। ইয়েটসের নিজের কৃত্রিম জগতে সেটি শোনা যাচ্ছিল না। এজরা পাউন্ড তো ঝুঁকে পড়েছিলেন ফ্যাসিবাদের দিকেই। পাঠকরা এগিয়ে গেছে, সে-তুলনায় বড় বড় লেখকের অগ্রগতি ঘটেনি; শ্রেণিগত বিপ্লবভীরুতা তাঁদের অব্যাহতি দেয়নি। কোথাও কোথাও দেখা গেছে রচনার আঙ্গিক বড় হয়ে উঠতে চাইছে বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে। যার মূল কারণ হচ্ছে বিষয়বস্তুর ভেতর সারবস্তুর সংকোচন। ব্যাধিকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরাও ব্যাধির কারণ যে পুঁজিবাদ সেটা ধরতে পারেননি বা ধরতে চাননি।
একই কারণে চিত্রকলায় দেখা দিয়েছে জীবনমুখিতার বদলে আত্মমুখিতা। এসেছে সুররিয়ালিজম, কিউবিজম, দাদাইজম। ব্যতিক্রম হচ্ছেন পিকাসো। কিন্তু তিনি তো প্রায় একলা পথিক।
কেউ কেউ অবশ্য ঝুঁকেছিলেন কমিউনিজমের দিকেই। কিন্তু থাকতে পারেননি। শ্রেণি অবস্থান তাঁদের আর এগুতে দেয়নি। টেনে পেছনে নিয়ে এসেছে। কমিউনিজমকে তাঁরা ঈশ্বর ভেবেছিলেন, পরে ভাবলেন ঈশ্বরের পতন ঘটেছে। বিপ্লবীদের সাহায্য করবার জন্য জর্জ অরওয়েল যোগ দিয়েছিলেন স্প্যানিশ বিপ্লবীদের সংগ্রামে, কিন্তু বিপ্লবীদের পেছনে তথাকথিত স্ট্যালিনবাদ রয়েছে মনে করে ব্যঙ্গরচনা লিখলেন বলশেভিক বিপ্লবের বিরুদ্ধেই। তাঁর কাছে মনে হয়েছে বলশেভিজমে আর ফ্যাসিজমে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। আবার এটাও জানা গেছে যে শিল্প-সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লববিরোধিতার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বিশ্বের আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ যেমন কাজ করেছে তেমনি বৈষয়িক পৃষ্ঠপোষকতাও যে তৎপর ছিল না, এমন নয়। অসমাপ্ত