বর্তমানে মানুষের জীবনকেন্দ্রিক যে শব্দটি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে তা হচ্ছে ‘লাইফস্টাইল’। লাইফ বলতে আমরা জীবনকে বুঝি। আর স্টাইল বলতে ধরন, প্রকার, ধাঁচ, রকম, পদ্ধতি ইত্যাদি বুঝি। তাই লাইফস্টাইলের সাধারণ বাংলা অর্থ হতে পারে জীবন যাপনের ধরন বা পদ্ধতি। এটাকে আরো সহজ করে বললে বলা যায় জীবনধারা।
এখন এই জীবনধারা তো অনেক ব্যাপক অর্থবোধক একটি শব্দ। এর বহুমাত্রিক অর্থ রয়েছে। জীবনের সার্বিক দিককেই কভার করে এ শব্দটি। এর মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেভাবে জীবন চালানো হচ্ছে তার পুরোটাই। এর মধ্যে যেমন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে খাদ্যগ্রহণ ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনগুলো পূরণের বিষয়গুলো রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানুষের মনোজগতে বদ্ধমূল হয়ো বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসের আলোকে কর্মের ধরনটিও।
জীবন ধারণের জন্য মানুষের কিছু মৌলিক প্রয়োজন রয়েছে। এই দেহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জন্মের শুরুতেই তার প্রয়োজন হয় খাবারের। প্রয়োজন হয় পরিচ্ছন্নতার। প্রয়োজন হয় সুন্দর একটি পরিবেশের যেখানে থাকবে কলুষমুক্ত বাতাস। আরো দরকার পরিবেশের বিরূপতা থেকে সুরক্ষার জন্য নিরাপদ স্থান বা গৃহ। একই কারণে প্রয়োজন হয় পরিধেয় বস্ত্র। আলো, তাপ ও শীতের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। তার ভেতর স্বাভাবিকতা বা সুস্থতার ব্যত্যয় ঘটালে প্রয়োজন হয় চিকিৎসার বা নিরাময়ের।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অনিবার্য প্রয়োজন বাতাস। শ্বাস-প্রশ্বাস চালু না থাকলে কয়েক মুহূর্তেই জীবন নিভে যায়। মহান স্রষ্টা আল্লাহ প্রকৃতিতে দিয়েছেন অনাবিল বাতাস। সেই বাতাস দেহে টেনে নেয়ার জন্য শরীরের ভেতর দিয়েছেন একটি অতুলনীয় যন্ত্র যার নাম হৃদযন্ত্র। এ বাতাস টেনে নেয়ার শক্তি না থাকলে পৃথিবীর জীবন আর থাকে না।
জীবনকে সতেজ সজীব রাখতে, পরিচ্ছন্ন রাখতে পানির প্রয়োজনও অনিবার্য। বাতাস পানি আর সূর্যের আলোর সমন্বয়ে গয়ে উঠেছে অসাধরণ এক প্রকৃতিজগত। যার মধ্যে জীবন স্বাভাবিক ও সুন্দর।
সার্বিকভাবে জীবনের পরিপার্শ্ব স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে প্রয়োজন এই প্রকৃতির উপস্থিতি। উদ্ভিদ, গাছ-পালা, বনবনানী, তরুলতা, পশু-পাখি সমৃদ্ধ; পাহাড়-নদী-সাগর ঝর্ণাধারা বেষ্টিত প্রকৃতির মাঝে মানুষের জীবন থাকলেই সে জীবন স্বাভাবিকভাবে বাঁচে। এই প্রকৃতি বিনষ্ট হলে বা এর সুযোগগুলোর ঘাটতি হলে জীবন বিপন্ন হয়।
তারপর বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজন হয় অপর মানুষের সহযোগিতা। এজন্য মানুষ গড়ে তুলেছে সমাজ। গড়েছে সংস্কৃতি, কালচার। এসব গড়তে জ্ঞানের প্রয়োজন হয়েছে। সেই জ্ঞানও মানুষকে চেষ্টা করে অর্জন করতে হয়। সেই অর্জনই হলো শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন। অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ দুনিয়ার জীবনকে সুন্দর, নিরাপদ ও উন্নত করতে পারে। তাই শিক্ষাও মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য প্রয়োজন।
এবার জীবিকার প্রয়োজন পূরণের জন্য শিক্ষাগ্রহণে সমৃদ্ধ হয়ে মানুষকে করতে হচ্ছে নানা ধরনের কাজ। প্রয়োজন বা চাহিদাই এর চালিকা শক্তি। এর পেছনে সবাইকে দৌড়াতে হচ্ছে। ঘর বাঁধতে হচ্ছে নারী-পুরুষকে। তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় জন্ম নিচ্ছে মানবশিশু। তাদেরকে লালনপালন করে আবার বড় করতে হচ্ছে, গড়ে তুলতে হচ্ছে আরেকটি পূর্ণ মানুষ হিসেবে জীবনের সবরকম দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে। এভাবে রূপ লাভ করছে সমাজ-সংস্কৃতি।
মানুষকে তার অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে জীবনের সব প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা যেমন করতে হচ্ছে, তেমনি যেকোনো ধরনের বাধা, প্রতিবন্ধকতা বিরূপতা দূর করে, বা সমস্যা সংকটের সমাধান করে জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
এভাবে প্রকৃতি ও সমাজ-সংস্কৃতির ভেতর মানুষ যে জীবন যাপন করছে সেটাই তার লাইফস্টাইল বা জীবনধারা।
বর্তমানে মানুষের জীবনের সুস্থতার জন্য সঠিক লাইফস্টাইল তথা জীবনধারার কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ একটাই, আজ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত। প্রকৃতি কলুষিত। জীবন কঠিভাবে সংকটাপন্ন। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ ও ভুল জীবন পদ্ধতির কারণে কঠিন কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেখা দিচ্ছে শারীরিক-মানসিক বিপর্যয়।
এজন্যই লাইফস্টাইল সঠিক করার জন্য, সংশোধন করার জন্য এতো উচ্চাবাচ্য শুরু হয়েছে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে জীবনের সাথে এমনসব অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে যে, মানুষ সেসব থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সেগুলো পরিহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যে জীবনকে মানুষের ভালোবাসার কথা তার প্রতি সুবিচার করতে পারছে না।
ইংলিশ অভিধানে lifestyle তথা জীবনধারার একটি সংজ্ঞা হলো এমন – একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সমষ্টির মনোভাব, অভ্যাস বা সম্পদের মিলনে গড়ে ওঠা একটি সংস্কৃতি।
ইংলিশ অভিধানে লাইফস্টাইল শব্দটির প্রতিশব্দগুলো হচ্ছে – behaviour ব্যবহার বা আচরণ, civilization সভ্যতা-সংস্কৃতি, condition অবস্থা, শর্ত, conduct আচরণ, পরিচালনা, customs রীতি, প্রথা, life · mores রীতিনীতি, চালচলন, position অবস্থান, situation পরিস্থিতি, way of life জীবনপথ বা জীবনপদ্ধতি।
এ থেকেই বোঝা যায়, লাইফস্টাইল বিষয়টি কতো ব্যাপকভাবে জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে। জীবনের কতো দিক ও বিভাগকে এটি ধারণ করে। কাজেই সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপনের জন্য জীবনের সাথে যুক্ত সব বিষয়েরই সুস্থতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। প্রয়োজন জীবনকে ভালোবাসা এবং জীবনের মূল্য বোঝা।