নিজস্ব প্রতিবেদক
চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে তার সূক্ষ্মভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অ্যাস্ট্রো-ব্যালের মাধ্যমে প্রদক্ষিণ করে, কিন্তু কখনই নিজে ঘুরপাক খায় না। সে কারণে আমরা সব সময় চাঁদের একটি মাত্র পীঠই দেখতে পাই। কিন্তু “লুনার রিসেশন” নামে এক প্রক্রিয়ার ফলে চাঁদ ধীরে ধীরে আমাদের গ্রহ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাপোলো মিশনের মহাকাশচারীরা চাঁদের পীঠে যেসব রিফ্লেক্টার বা প্রতিফলক বসিয়েছিলেন তার ওপর লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি শতভাগ নির্ভুলতার সঙ্গে পরিমাপ করতে সক্ষম হয়েছেন যে চাঁদ ঠিক কত দ্রুত গতিতে পৃথিবীর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তারা নিশ্চিত করছেন, চাঁদ প্রতি বছর ১.৫ ইঞ্চি (৩.৮ সেমি) হারে দূরে সরে যাচ্ছে এবং এর ফলে আমাদের দিনের দৈর্ঘ্য একটু একটু করে বাড়ছে।
লন্ডনের রয়্যাল হলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিও-ফিজিক্সের অধ্যাপক ডেভিড ওয়ালথাম বলেছেন, ‘এসবই হচ্ছে জোয়ারের জন্য।’ চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি গবেষণা করেন।
তিনি বলেন, ‘জোয়ারের টানের ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণন ধীর হয়ে আসে এবং সেই শক্তিতে চাঁদে কৌণিক ভরবেগ তৈরি হয়।’
মূলত, পৃথিবী তার কক্ষপথে ঘোরার সাথে সাথে একটু দূরে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সমুদ্রে জোয়ার ও ভাটার সৃষ্টি করে। এই জোয়ার সমুদ্রের পানিকে ‘ফুলিয়ে’ দেয় যা উপবৃত্তের আকারে একবার চাঁদের অভিকর্ষের দিকে এবং অন্যবার বিপরীত দিকে প্রসারিত হয়। কিন্তু যেহেতু পৃথিবী তার অক্ষের ওপর চাঁদের কক্ষপথের চেয়েও অনেক বেশি দ্রুতবেগে ঘুরছে, তাই চাঁদের নীচের সমুদ্রের অববাহিকাগুলোর সাথে ঘর্ষণের কারণে চাঁদ সেই জলকে টেনে ধরে রাখতে কাজ করে।
এর মানে হলো, সমুদ্রের পানির এই ফুলে ওঠার ব্যাপারটি ঘটে চাঁদের কক্ষপথের কিছুটা সামনে। চাঁদ তখন এটিকে পেছনের দিকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করে। ফলে সামান্য হলেও এটি আমাদের গ্রহের ঘূর্ণন শক্তিকে কমিয়ে দেয়।
চাঁদের শক্তি অর্জনের সময় পৃথিবীর আরও ঘূর্ণন ধীর হয়ে যায়, যার ফলে চাঁদ একটু ওপরের কক্ষপথে সরে আসে।
সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আমাদের গ্রহের ঘূর্ণনের এই ক্রমবর্ধমান ধীরগতির মানে হল যে ১৬০০ শতকের শেষের দিক থেকে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রতি শতাব্দীতে গড়ে প্রায় ১.০৯ মিলি-সেকেন্ড হারে বেড়েছে।
চন্দ্র গ্রহণের ওপর প্রাচীন পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি অন্যান্য পরিমাপগুলিতে এই সংখ্যাকে আরও একটু বেশি করে দেখানো হয়েছে – প্রতি শতাব্দীতে ১.৭৮ মিলি-সেকেন্ড হারে। এমনিতে এটি খুব বেশি বলে মনে না হলেও পৃথিবীর সাড়ে চারশো কোটি বছরের ইতিহাসে এটা এক গভীর পরিবর্তনকে তুলে ধরে।
সৌরজগতের জন্মের পরে প্রথম পাঁচ কোটি বছর পর বা তার কাছাকাছি সময়ে চাঁদ তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
এনিয়ে সবচেয়ে বেশি যে তত্ত্বটিকে মেনে নেয়া হয় তা হলো: পৃথিবী যখন মাত্র গঠিত হয়েছে বা হচ্ছে, সে সময় মঙ্গল গ্রহের আকারের অন্য একটি বস্তু, যেটি থিয়া নামে পরিচিত, তার সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এর ফলে পৃথিবীর একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যাকে এখন আমরা চাঁদ বলে ডাকি। পৃথিবীতে পাথরের স্তরের মধ্যে সংরক্ষিত ভূতাত্ত্বিক তথ্য থেকে এখন যেটা স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো, আজকের তুলনায় অতীতে চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি জায়গায় ছিল।
বর্তমানে চাঁদের অবস্থান পৃথিবী থেকে ৩,৮৪,০০০ কি.মি. (২,৩৮,৮৫৫ মাইল) দূরে। কিন্তু একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩২০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটগুলো মাত্র ঘুরতে শুরু করেছিল এবং মহাসাগরে বসবাসকারী অণুজীবগুলি নাইট্রোজেন খেতে শুরু করেছিল, সেই সময়ে চাঁদ পৃথিবী থেকে মাত্র ২,৭০,০০০ কি.মি. (১,৭০,০০০ মাইল) দূরে অবস্থিত ছিল, যা বর্তমান দূরত্বের তুলনায় প্রায় ৭০%।
জার্মানির ফ্রিডরিশ শিলার ইউনিভার্সিটির ভূ-পদার্থবিদ টম ইউলেনফেল্ড বলেন, ‘সেই সময় পৃথিবী এত দ্রুত গতিতে ঘুরতো যে তা দিনের দৈর্ঘ্য কমিয়ে দিয়েছিল। তখন (২৪ ঘণ্টার মধ্যে) দুটি সূর্যোদয় এবং দুটি সূর্যাস্ত ছিল, এখনকার মতো একটি করে নয়।’
তিনি বলেন, ‘এটি হয়তো দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমিয়ে এনেছে এবং সালোক-সংশ্লেষণকারী যেসব জীব তাদের জৈব রসায়নকে প্রভাবিত করেছে।’
তার এবং অন্যান্যদের গবেষণা থেকে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, লুনার রিসেশনের হারও কিন্তু সব সময় একই ছিল না – সময়ের সাথে সাথে এর গতি কখনও বেড়েছে এবং আবার কখনও কমে গেছে।
আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সাল্টার ভূতাত্ত্বিক ভ্যানিনা লোপেজ ডি আজারেভিচের একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, প্রায় ৫৫০-৬২৫ মিলিয়ন বছর আগে চাঁদ বছরে ২.৮ ইঞ্চি (৭ সেমি) পিছিয়ে যেতো।